প্রাচীন কলকাতার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিবমন্দির যেখানে মূর্তিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় / চলুন ঘুরে আ

1 year ago

আমরা বাঙালিরা শ্রাবণ মাস এলেই চোখ বন্ধ করে যে ছবি মনের ক্যানভাসে দেখতে পাই তা হল ব্যোম ব্যোম তারক ব্যোম! বাঁক নিয়ে গঙ্গা থেকে জল নিয়ে তারকেশ্বরের উদ্দেশ্যে চলা অগণিত ভক্তবৃন্দের ঢল।
কিন্তু, আমরা কলকাতার বিখ্যাত ও সুপ্রাচীন শিব মন্দিরের খোঁজ ক'জন জানি। এবার আমাদের ব্লগে এরকমই কিছু বিখ্যাত শিব মন্দিরের ভিডিও ও তাদের ইতিহাস নিয়ে উপস্থাপনা করার ইচ্ছে রইল। আপনাদের যদি আগ্রহ তৈরি হয় এই বিষয়ে জানার, তবে সেগুলো পরপর উঠে আসবে আমাদের প্রযোজনায়।

কলকাতার মন্দির সম্বন্ধে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, কলকাতাবাসী মা কালীর পুজো সাধনায় সর্বাগ্রে। জয় কালী কলকাত্তাওয়ালী। সুপ্রচলিত ও সুবিদিত স্লোগান। কিন্তু মা কালির সাথে সাথে শিব-দুর্গা ও অন্যান্য আঞ্চলিক দেবদেবীরও পূজা হয়ে আসছে দীর্ঘদিন। স্থাপত্যের নিরিখে দেখতে গেলে কিছু কিছু মন্দির কলকাতার জন্মেরও পূর্বের। তবে, কলকাতার বেশিরভাগ মন্দিরই ছিল সেসময় ধনীসম্প্রদায়ের অধীনে। 1856 সালের তথ্য অনুযায়ী, কলকাতায় সেই সময় 24টি শিব মন্দির ও 5টি কালীমন্দির ছিল জানতে পারা যায়। বাংলার আটচালা শিল্পের অনুকরণে ও টেরাকোটা অলংকরণে গঠিত ছিল বেশিরভাগ মন্দির গুলো।
এরকমই একটা মন্দির আজ উঠে এসেছে আজ আমাদের চিত্রকল্পে।

হালফিলের হিন্দি পৌরাণিক সিরিয়ালগুলোতে আমরা মহাদেবের সিক্স প্যাক দেখি, কিন্তু বাঙালি মহাদেবকে তো আমরা বেশ ভুঁড়িওলা মোটাসোটা চেহারাতেই জানি। ভালোবেসে তাই নিমতলা ঘাটের কাছে একটা প্রাচীন শিবমন্দিরের বিরাট উঁচু ও চওড়া শিবলিঙ্গকে সবাই ডাকে 'মোটা মহাদেব' বলে! যদিও মন্দিরটির আসল নাম 'দুর্গেশ্বর শিব' মন্দির। এখন প্রশ্ন হলো দুর্গেশ্বর নাম কেন? এখানে কি কোন প্রাচীন দুর্গ ছিল? না আসলে তা নয়। দুর্গা+ঈশ্বর , বা দুর্গার স্বামী অর্থাৎ মহাদেবকেই বোঝানো হয়েছে। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মদন মোহন দত্তের পুত্র রসিকলাল দত্ত ও জহর লাল দত্ত। প্রশ্ন হলো কে এই মদন মোহন দত্ত? মদন মোহন দত্ত হলেন হাটখোলা দত্ত পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ব্রিটিশদের সাথে বাণিজ্য করতেন। শোনা যায়, তাঁর বিশাল একটা জাহাজ ছিল। 1766 খ্রিস্টাব্দে জালিয়াতির অভিযোগে বিলাতি আইন অনুযায়ী কলকাতার কালো জমিদার গোবিন্দ রাম মিত্রের প্রপৌত্র রাধাচরণ মিত্রের যখন ফাঁসির হুকুম হয়, তখন কলকাতার 95জন নাগরিক ব্রিটিশ কাউন্সিল এর কাছে মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাহারের দাবিতে স্বাক্ষর করেন, মদন মোহন দত্ত ছিলেন তার অন্যতম।

এবার আসা যাক মন্দিরের দেবতা প্রসঙ্গে। অনুমান করা হয়, লিঙ্গটি তৈরি করা হয় মন্দিরের ভিতরে। শিল্পী ছিলেন গদাধর দাস।

ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, এখানে এক সময়ে পঙ্খ ও টেরাকোটার কাজ ছিলো। মন্দিরের পশ্চিমের দরজার ওপরে, সংস্কৃত ভাষায় কিন্তু বাংলা হরফে একটা প্রতিষ্ঠালিপি আছে। এতে লেখা আছে –
“অঙ্গৌষধীশ ধরণীধর
শীতরশ্মি। প্রখ্যাত শাক
সময়ে পিতৃরাজ্ঞয়ৈতত
সংস্থাপিতং মদনমােহন
দত্ত পুত্রৈ দুর্গেশ্বরাখ্যা শিব
লিঙ্গমভূত সুসৌধে। ১৭১৬”
প্রায় ৫০ ফুট উচ্চতা, ২৪ ফুট লম্বা এবং ৩০ ফুট চওড়া এই সুবিশাল প্রাচীন ভাঙাচোরা মন্দিরটি বাংলার আটচালা মন্দিরের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মন্দিরের মাথা থেকে গা পর্যন্ত নেমে এসেছে বটের ঝুরি, যা দেখতে অনেকটা শিবের জটার মত।

আটচালা এই বৃহত্তর মন্দিরের ভাস্কর্যের রূপকার ছিলেন শ্রী গদাধর দাস । মন্দিরের ভিতরে রয়েছে কালো পাথরের তৈরি প্রায় ১০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি শিবলিঙ্গ, যার পোশাকি নাম দুর্গেশ্বর শিব। তবে এই শিবলিঙ্গের আকার দেখে ভক্তরা এনাকে মোটা শিব নামে সম্বোধন করেন। বিভিন্ন পূজা অনুষ্ঠানে শিবলিঙ্গে জল ঢালার জন্য পাশে রয়েছে একটি বড় লোহার সিঁড়ি।

শিব মন্দিরের ইতিহাস ও প্রাচীন রহস্য উন্মোচন:-
ব্রিটিশ শাসিত কলকাতার অন্যতম গণ্যমান্য ব্যক্তি হাটখোলার দত্ত পরিবারের মদনমোহন দত্তের দুই পুত্র রসিকলাল দত্ত এবং জহরলাল দত্ত আনুমানিক ১৭৯৪ সালে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিশতাধিক বছরের পুরনো এই ভগ্নপ্রায় আটচালা মন্দির সম্পর্কে বেশ কিছু লোককথা কথিত আছে।

শোনা যায়, বহুকাল আগে এই মন্দিরের একজন পুরোহিত রাত্রিবেলা পুজো শেষ করে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে বাড়ি ফিরে যান। পরদিন সকালে এসে মন্দিরের দরজা খুলতেই তিনি দেখেন মন্দির শূন্য। শিবলিঙ্গ সেখানে নেই। বহু খোঁজার পর সেই শিবলিঙ্গকে তারা পাশে অবস্থিত গঙ্গা নদীর তীরে খুঁজে পান এবং তাঁকে আবার মন্দিরে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। এইভাবে শিবলিঙ্গ যাতে ঘুরে বেড়াতে না পারেন সেটি বন্ধ করার জন্যই এই মোটা শিবকে পরবর্তীতে শিকল দিয়ে আবদ্ধ করা হয়। তবে কেউ কেউ আবার মনে করেন তখন কংক্রিট ছিল না বলে মাটির বেদির উপরে এই শিবলিঙ্গ রাখা হত। গঙ্গা মন্দিরের খুব কাজ দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় জোয়ারের জল এই মন্দিরে প্রবেশ করে শিবলিঙ্গকে নড়িয়ে তার স্থানচ্যূত করত। ফলে, শিবলিঙ্গ যাতে আবার নড়ে না যায় সেই জন্য শিবলিঙ্গকে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও অনেকেই মনে করেন।

মন্দিরে প্রবেশের সময়:-
প্রতিদিন ভোর ৪.৩০ থেকে দুপুর ১২.০০ অবধি মন্দির খোলা থাকে। আবার বিকেল ৪.০০ থেকে মন্দির পুনরায় খোলা হয়। দিনের বেলা ভক্তদের জন্য মন্দিরে প্রবেশ এবং পুজো দেওয়ার কোনো বাধা-নিষেধ নেই।

বিশেষ আকর্ষণ:-
• বিকালবেলার সন্ধ্যা আরতি।

• মহাদেবের ফুলের রাজবেশ।

গন্তব্যে পৌঁছানোর যাত্রাপথ:-
• হাওড়া স্টেশন থেকে ফেরিলঞ্চে আহিরীটোলা পৌঁছে সেখান থেকে মাত্র ১০ মিনিটের হাঁটা পথে এই মন্দিরে পৌঁছনো যায়।

• কলকাতা থেকে চক্ররেলে শোভাবাজার আহিরীটোলা পৌঁছনো যায়। এরপর সেখান থেকে হেঁটে এই মন্দিরে যাওয়া যায়।

• অথবা, মেট্রোরেল করে শোভাবাজার সুতানটি স্টেশনে নেমে, সেখান থেকে নিমতলা পৌঁছনোর অটো ধরতে হয়। আবার বিধাননগর থেকে নিমতলা যাওয়ার অটো করে এই মন্দিরে আসা যায়।

#onedayouting #travelvlog #weekendtrip #weekendvlog #onedaytrip #weekendtripfromkolkata #নিমতলা #শোভাবাজার_আহিরিটোলা #দুর্গেশ্বর_শিব #মোটাশিব #onehourouting

Loading comments...